মুখস্তের দিন কি তবে শেষ ?

ড: মঞ্জুরে খোদা
ড: মঞ্জুরে খোদা
4 Min Read
নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে কথা আছে। সে কথা বলবো। যারা মনে করেন, মুখস্তের দিন শেষ সে ধারণা খন্ডিত। পুরোপুরি ঠিক নয়। স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করা শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দার্শনিক রার্টন্ড রাসেলের মতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূলত দুটি বিষয় শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারে; একটি হচ্ছে ভাষা, অন্যটি হচ্ছে গণিত। কিন্তু গণিতও শেষ বিচারে একটি ভাষা। সেই হিসেবে শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ছাত্রদের ভাষা শিক্ষা দেয়া। ভাষার মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন হয়। সেটা না থাকলে তা সম্ভব হয় না। সেই ভাষা শিখতে হলে তার ব্যকরণ ও পদ্ধতিগত বিষয়গুলো মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
অংক করতে গেলে শিক্ষার্থীদের নামতা মুখস্ত রাখতে হবে। বিজ্ঞান ও গবেষণার নানা বিষয়ে কাজ করতে অনেক সূত্র ও তত্ত্ব মাথায় রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে মনে রাখাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সেটা একটি ধারাবাহিক চর্চা ও বিকাশের বিষয়। সেটা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারমানে এই নয় যে সব কিছুই মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে। এ সবের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনতে হবে। শিক্ষার মধ্যে আনন্দ ও আগ্রহ তৈরী করা না গেলে- শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফাঁকির প্রবণতা বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এমন ভাবনা আরো বিপদ তৈরী করবে।
ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে মুখস্তবিদ্যা বা স্মরণশক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ জাপানের ভাষার বৈশিষ্ট দিয়ে- তার একটি উদাহরণ টানছি। বিশ্বের সব ভাষার ধরণ ও শিক্ষা একরকম নয়। সেখানে আছে নানা বৈচিত্রতা। আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন সে সব দেশে উন্নতর শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণের জন্য যাবেন- তখন তাদের এই গুণাবলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং মুখস্তবিদ্যাকে নাকচ করার ধারণা কথা ভুল।
”জাপানি ভাষা শিক্ষা এক দুর্লভ প্রতিভা ও অসীম ধৈর্য্যরে কাজ। ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে জাপানি ছাত্রছাত্রীদের ব্যয়িত সময় ও স্মরণ শক্তি অত্যন্ত আগ্রহ উদ্দীপক। সারা দুনিয়ার ছাত্ররা মাত্র ২৬ থেকে ৩৩টি র্বণমালা জানার মাধ্যমে তারা তাদের ভাষা ও সাহিত্যকে বুঝে নিতে পারে, কিন্তু জাপানিদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। কারণ তাদের ভাষার পরিধি অনেক ব্যাপক। জাপানি শিক্ষার্থীরা যখন প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করে তখন তাদের ১০০৬ টি কাঞ্জি (জাপানি অক্ষর বা বর্ণমালা) শিখতে হয়, এবং তাদের বয়স যখন ১৫’র কাছাকাছি তখন তারা আরও ১১৩০ কাঞ্জি শিখে ফেলে। এভাবেই জাপানি শিক্ষার্থীরা ৩ থেকে ৪ হাজার কাঞ্জি মাথায় নিয়ে চলাফেরা করে।
জাপানিদের ভাষাজ্ঞান ও ভাষাশিক্ষা সম্পর্কে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সত্যেন বোস’র বক্তব্য যথাযথ। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ভারতীয় ভাষাগুলোর তুলনায় জাপানি ভাষার কতগুলো অসুবিধা আছে। যারা একটু খবর রাখেন তারাই তা জানেন। একটা অসুবিধা হলো এই যে, আমাদের যেমন অল্পসংখ্যক অক্ষর দ্বারাই সব বাক্য লেখাও যায়, বইতেও ছাপানো যায়, জাপানি ভাষাতে সে ব্যবস্থা নেই। তাদের আছে নিজের অক্ষর এবং চৈনিক অক্ষর প্রায় হাজার তিনেক। যারা উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক তাদের এসবকটাকেই শিখতে হয়। এর জন্য আমাদের দেশে যেখানে মাতৃভাষা বছরখানেক বা বছর দুয়েকের মধ্যে চলনসই আয়ত্তের মধ্যে এসে যায়, ছেলেমেয়েদের সেখানে জাপানি ভাষা শিখতে গড়ে লাগে প্রায় ছয় বছর।
জাপানের অভিভাবকরাই বলতে পারবেন, তারা কতটা ধৈর্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সন্তানদের জাপানি ভাষা লিখতে-পড়তে এবং হাজার হাজার কাঞ্জি মুখস্ত করাতে কতটা সময় ব্যয় করেছেন। কাঞ্জির সাথে উপরন্তু আরও দুই সেট অক্ষর শিখতে হয়। যথা ‘হিরাকানা’ নামক আরও ৪৬টি অক্ষর বা জাপানি বর্ণমালা এবং ‘কাতাকানা’ নামক আরও ৪৬টি অক্ষর বা জাপানি বর্ণমালা, মানে আরও মোট ৯২টি অক্ষর মুখস্ত করতে হয়। সাধারণ জাপানি ভাষা লিখতে-পড়তে কাঞ্জির সাথে ‘হিরাকানা’ যুক্ত করে বা ব্যবহার করে লিখতে-পড়তে হয়। আর ‘কাতাকানা’ সাধারণত বিদেশি শব্দ ও ভাষার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে কাঞ্জির সাথে ‘কাতাকানা’ শব্দের ব্যবহার করতে হয়। এত অসুবিধা-জটিলতা সত্তে¡ও প্রত্যেকেই একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করে নিপুণতার সাথে তাদের ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। বিদ্যালয়গুলোতে ভাষা শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি সপ্তাহে ২০৫ মিনিট (প্রায় পৌনে ৪ ঘণ্টা) ব্যয় করতে হয়।” জাপানের শিক্ষার্থীদের এই মুখস্তবিদ্যা ও স্মরণশক্তির প্রতিভা বিশ্বে তাঁদের অনন্য মর্যাদা দিয়েছে।
Share This Article