স্বতন্ত্র’র পাল্লা ভারী কে হবে বিরোধী দল

সুজন মাহমুদ
সুজন মাহমুদ
7 Min Read

অনলাইন ডেস্ক:

একসময় রাজাদের সভায় কবি থাকতেন, ভাঁড় থাকতেন। তখন ছিল রাজতন্ত্র। এখন তো সেই আমল নেই। এখন গণতন্ত্র। তাই এখন রাজাদের দল থাকে। তাদের গালভরা নাম কিংস পার্টি। বাংলাদেশে এই টার্মটি জনপ্রিয় হয়েছিল এক-এগারোর সরকারের সময়। তবে এ ধারণা বাংলাদেশে আরও পুরোনো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ চলে যায় সামরিক তন্ত্রের কবলে। ক্যান্টনমেন্টে বসেই চলে রাজনীতির খেলা। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হতো অরাজনৈতিক কেন্দ্র থেকে। ক্যান্টনমেন্টে বসেই জিয়াউর রহমান গড়ে তোলেন বিএনপি। একই কায়দায় এইচ এম এরশাদ গড়ে তোলেন জাতীয় পার্টি। তবে রাজাদের গড়া দল নয়, রাজাদের আনুকূল্যে গড়া রাজনৈতিক দলই আসলে পায় ‘কিংস পার্টি’র মর্যাদা। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে কিংস পার্টি হলো ‘সম্মিলিত বিরোধী দল-কপ’। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে এই কপ গড়ে উঠেছিল এরশাদের অধীনে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচন বৈধতা দিতে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, একসময় জাসদের দেশ কাঁপানো নেতা আ স ম আবদুর রব হয়েছিলেন দেশের প্রথম গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা। প্রথম হলেও আ স ম রব একমাত্র হতে পারেননি। ১৯৯৮ সালে যারা গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়েছিল, সেই জাতীয় পার্টিই দশম ও একাদশ সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দল হয়েছে। ’৮৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে এরশাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জন্ম নেয় ফ্রিডম পার্টি। ’৭৫-এর আত্মস্বীকৃত খুনিদের নেতৃত্ব গঠিত ফ্রিডম পার্টিও অন্য সব কিংস পার্টির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
বলছিলাম এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। সেই সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল বিরাজনীতিকীকরণ। এক-এগারোর সময় ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি বা পিডিপি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৪৫ দিন আগে নিবন্ধন পায় দলটি। ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর নিবন্ধন পেয়েছিল মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। জনগণের কোনো কল্যাণে না এলেও কল্যাণ পার্টি এখনো টিকে আছে। বিএনপির সঙ্গে মিলে দীর্ঘদিন সরকারবিরোধী আন্দোলন করলেও শেষ মুহূর্তে জেনারেল ইবরাহিম নির্বাচনে অংশ নিয়ে কল্যাণ পার্টির কিংস পার্টির বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছেন। এক-এগারোর সময় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দল ‘নাগরিক শক্তি’ আত্মপ্রকাশের মাস তিনেক পরেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহম্মদের ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠলেও তা স্থায়ী হয়নি।

সব নির্বাচনের আগেই কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণি সক্রিয় হয়। দরকষাকষির খেলায় এমপি হওয়ার সুযোগ নিতে মাঠে নামে খুচরা কিছু দল। ২০১৪ ও ’১‌৮ সালের নির্বাচনে এমন কিছু সুবিধাবাদীর কপালে এমপি হওয়ার সুযোগ জুটেছে। একসময়কার বিএনপি নেতা প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিএনপির বিকল্প হিসেবে বিএনএফ গঠন করেছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার দল ছিনতাই করে এমপি বনে যান আবুল কালাম আজম। সেই বিএনএফ এখনো আছে। এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তিনটি আসনে নির্বাচন করছেন। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা যা বলে, এবার আর ২০১৪ সালের মতো তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না। ছিঁড়বে যে না, সেটা তিনিও জানেন। তবুও নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির সুবিধা নিতে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু সরকার এবার আর তাকে পাত্তা দেয়নি।

বিএনএফকে পাত্তা দেওয়ার মতো কোনো কারণও ঘটেনি। সরকার এবার বিএনপির বিকল্প হিসেবে বিএনএম, বিএসপি, তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছিল। অন্য অনেক সক্রিয় দলকে না দিয়ে নির্বাচন কমিশনও অখ্যাত এসব দলকে নিবন্ধন দিয়েছিল। নির্বাচনের আগে একেকজনের হম্বিতম্বিতে টেকা দায় ছিল। সবাই দাবি করছিলেন, বিএনপির বড় বড় নেতা তাদের দলে যোগ দেবেন, বিএনপি ভেঙে পড়বে। তারাই আগামী নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবেন। অন্তত বিরোধী দল হবেন। কিন্তু মাঠে নেমে দেখা গেল, বিএনপি নেতাদের তেমন কেউই বিএনএম বা তৃণমূল বিএনপির আস্থা রাখেনি। অনেক আগেই বিএনপি থেকে দলছুট শমসের মুবিন চৌধুরী আর তৈমূর আলম খন্দকার এখন নিজেদের লুঙ্গি বাঁচাতেই ব্যস্ত। অনেক গর্জন করলেও কোনো বর্ষণ করতে না পারায় সরকারি দলও বিএনএম, বিএসপি বা তৃণমূল বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। কিংস পার্টির অবস্থা এখন না ঘরকা না ঘাটকা। বিরোধী দলের কাছে তারা বেইমান, বিশ্বাসঘাতক। আর সরকারি দলের কাছে অপ্রয়োজনীয়, অপাঙক্তেয়। দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতা হয়েছে। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২৬টি আসন, ১৪ দল পেয়েছে ৬টি। কিন্তু কিংস পার্টিগুলো কিছুই পায়নি। শোনা যাচ্ছে, তারা আশ্বাস পেয়েছে। তবে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরই ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে, তাতে কোনো আশ্বাসে কাজ হবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুতার ব্র্যান্ড বাটা। এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে বাটার মতো করে লোগো বানিয়ে কাটা, টাটাসহ নানা ব্র্যান্ডের জুতা আসে বাজারে। কিন্তু কোনোটাই বাটার মানের হয় না। তেমনি বিভিন্ন সময়ে বিএনপির বিকল্প হিসেবে বিএনএম, বিএনএফ, বিএসপি গঠন করা হয়েছে। কোনোটাই বিএনপি হতে পারেনি। বিএনপি নেতারা তো বটেই, জনগণও এই দলগুলোকে মেনে নিতে পারেনি। ভারতে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস হয়েছে। মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস অনেক দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছে। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছিলেন। কিন্তু তার দল নিবন্ধন পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান। তার মেয়ে অন্তরা হুদা দলের হাল ধরেছিলেন। এখন যে হাল শমসের মুবিন আর তৈমূর আলমের হাতে। কিন্তু মূল কথা হলো, তৃণমূল বিএনপি তৃণমূল কংগ্রেস হতে পারেনি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে ৩২টি আসন ছাড়ার পর ২৬৮ আসনে লড়ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করছেন ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরকে। রাশেদ খান মেনন বা হাসানুল হক ইনু দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোটসঙ্গী। কিন্তু বিএনপির অপছন্দের শীর্ষে জেনারেল ইবরাহিম।
গণতন্ত্রে বহু দল থাকবে, বহু মত থাকবে। পক্ষ থাকবে-বিপক্ষ থাকবে। মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। রাজনীতি হলো জনগণের জন্য। কিন্তু এখন রাজনীতি মানেই যেন সুবিধাবাদিতা। জনগণ বোকা নয়, তারা সেটি টের পেয়ে যায়। নির্বাচনের আগে হালুয়া-রুটির লোভে গজিয়ে ওঠা কিংস পার্টির সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এরা রাজনীতিকেই কলুষিত করে। রাজনীতিতে দলবদল বা জোটবদলও নতুন কিছু নয়। একসময় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে জন্ম নেওয়া জাসদ এখন আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট। একসময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি মিলে আন্দোলন করে এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। সেই জাতীয় পার্টি একসময় বিএনপির সঙ্গে মিলে চারদলীয় জোট গঠন করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। আবার এখন তারা আওয়ামী লীগের মহাজোটের সঙ্গী। ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’—এ কথা বলে রাজনীতিবিদরা নিজেদের অনেক অপকর্ম জায়েজ করে নেন। শেষ কথা বলে হয়তো কিছু নেই। কিন্তু স্রেফ সুবিধা পাওয়ার জন্য শেষমুহূর্তে গজিয়ে ওঠা কিংস পার্টিকে জনগণ কখনো গ্রহণ করে না। কোনো দল বা জোটেই তারা মর্যাদা পায় না। এরা ধূমকেতুর মতো আসে, ফানুসের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

Share This Article