মেহেরপুরের মুজিবনগর কমপ্লেক্সে পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি বাগানে এ বছর গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে খেজুর। চলছে সরকারের মাধ্যমে চারা তৈরির প্রক্রিয়া। মধ্যপ্রাচ্যে যে মান ও স্বাদের ফল হয় সেই মানের ফলই গাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। খেজুর চাষে সফলতা বলে কৃষি বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন প্রয়োজন এ অঞ্চলে একটি খেজুর রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব মধ্যপ্রাচ্যের ফল খেজুর চাষ। আর্টিফিশিয়াল পরাগায়নের মাধ্যমে বাড়ানো হয় গাছের ফল ধারণক্ষমতা। পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নেট দিয়ে আর বৃষ্টির পানি যাতে ফলে না পড়ে সেজন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে খেজুরের থোকা। যা দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন খেজুর বাগান করতে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়ার সঙ্গে এখনকার আবহাওয়ার মিল না থাকায় এ পর্যায়ে আসতে অনেক প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের। তবে এবছর অধিকাংশ গাছে পরিপূর্ণ ফল আসায় খুশি তারা। গতবছর কুড়িটি গাছে খেজুর এসেছিলো। এখন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে ফলের মিষ্টতা ধরে রাখার।
আমদানিনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের ফল খির খেজুর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে দেশেই এ ফল উৎপাদনের দ্বার খুলে গেল। ১০টি জাত নিয়ে মেহেরপুরের মুজিবনগরে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় খেজুর চাষ। কয়েকটি জাত বাছাই করে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে বলে জানালেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসকরা বলছেন, খেজুরটি দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হলে সহজে পূরণ হবে পুষ্টির চাহিদা। কমবে খেজুর আমদানি। এখন মেহেরপুরের মুজিবনগরে সৌদি আরবের খেজুরের চাষে সফলতায় কৃষি কর্মবিজ্ঞানী ও কৃষকরা আশার আলো দেখছেন। শুষ্ক অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে মেহেরপুর অঞ্চলের। তারপরও বেলে ও বেলে-দো-আঁশ মাটিতে ভালো জন্মে খেজুর গাছ। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ধরনের মাটিতেই খেজুর গাছ চাষ করা যায়। তবে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।

‘
মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কুষ্টিয়া কেন্দ্র মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স চত্বরে ২০১৪ থেকে খেজুরের চাষ শুরু করে। কাতার, ওমান, দুবাই, ইরান, সৌদি, সুদান থেকে আজোয়া, আম্বার, লুলু, খালাস, ডেগলেটনুর, কালমি, মাকতুম, সুক্কারি, বাহারি ও মরিয়ামসহ ১০টি জাতের বীজ নিয়ে আসেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কুষ্টিয়া। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বীজ বপন করা হয় কুষ্টিয়া সেচ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেই বীজের ২ হাজার চারা রোপণ করা হয় মুজিবনগর কমপ্লেক্সে। বপনের আড়াই বছরের মধ্যে ৪টি গাছে ফলও আসে। খেজুর গাছের পরাগায়ন পোকামাকড়, মৌমাছি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে খুব কম হয়। তাই হাত দিয়ে অথবা মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরাগায়ন করতে হবে। বাগানে ১০০টি স্ত্রী গাছের সঙ্গে মাত্র একটি পুরুষ গাছ থাকলেই পরাগায়নের জন্য যথেষ্ট। পরাগায়ন করতে হলে স্ত্রী গাছের ফুল চুরমি ফেটে বাইরে আসার পর পুরুষ গাছের পরাগরেণু পাউডার নিয়ে স্ত্রী গাছের পুষ্পমঞ্জুরিতে লাগিয়ে দিয়ে চুরমির অগ্রভাগ রশি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ২-৩ দিন পর পর পুনরায় পরাগায়ন করলে ভালো ফল হয়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কুষ্টিয়া জোনের আওতায় মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স চত্বরে খেজুর বাগানের তত্ত্বাবধায়ক মহিবুল ইসলাম বলেন, খেজুরের চারা রোপণ করতে হলে ৩ ফুট গভীর ও ৩ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট আড়াআড়ি গর্ত বানাতে হবে। ওপরের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি ওপরে দিতে হবে। গর্তের মাটি ১-২ দিন রোদে শুকিয়ে নিলে ভালো হয়। পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মাটির সঙ্গে গুঁড়া বিষ মেশাতে হয়। প্রতিটি গাছের গোড়ায় ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর সার মেশাতে হবে। চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন পর মিশ্র সার গাছের কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ফুট দূরে মাটিতে দিতে হয়। পানি স্প্রে করতে হবে। চারা রোপণের পর চারার গোড়া যেন শুকিয়ে না যায় আবার অতিরিক্ত পানিতে যেন কাদা না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব হবে ১৫ থেকে ২০ ফুট। দিনে কমপক্ষে ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা যাতে রোদ থাকে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। তাতে গাছের বৃদ্ধি ও রোগ-বালাই কম হবে। একরপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০টির বেশি গাছ রোপণ করা যাবে না।
ডা. সজীব উদ্দিন স্বাধীন বলেন, খেজুর খুবই পুষ্টিমান। ১ কেজি খেজুর ৩ হাজার ৪৭০ ক্যালরি শক্তি জোগান দেয়। খেজুরে গ্লুকোজ, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, তামা, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসকরবিক এসিডসহ নানা উপাদান রয়েছে।
মুজিবনগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ি) উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মু. আনিসুজ্জামান খান জানান, দেশে মধ্যপ্রাচ্যের ফল খেজুরের আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে সারা দেশে এ ফলের চাষ ছড়িয়ে দিতে হবে। এ চাষ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশে তাজা খেজুরের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়া ও বাংলাদেশের আবহাওয়া এক না হওয়ায় সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার। এই কর্মকর্তা এ অঞ্চলে সরকারিভাবে একটি ডেট রিসার্চ সেন্টার তৈরি দাবি জানান। তিনি আরও জানান- মেহেরপুরের মাটিতে মধ্যপ্রাচ্যের খেজুরের চাষ ভালো হচ্ছে। এখানকার আবহাওয়া ও মাটি খেজুর চাষের জন্য উপযোগী এবং এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে কীভাবে আরো ভালো করা যায়।