জর্জ অরওয়েল ১৯৪৬ সালে “হাউ দ্য পুওর ডাই (How the Poor Die)”-এ লিখেছিলেন যে, হাসপাতাল এক ধরণের “কবরের সামনের চেম্বার”। বর্তমান সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের ক্রমবর্ধমান খরচ, নোসোকোমিয়াল (হাসপাতালে অর্জিত) ইনফেকশনের ব্যাপক প্রসার, এবং চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের অসন্তোষ সম্পর্কে আমরা কম-বেশী সকলেই সচেতন। এরকম পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে স্বাস্থ্যসেবার একটি নতুন প্রবণতা আবির্ভূত হয়েছেঃ “বাড়িতে হাসপাতাল” বা “Hospital at home (HAH)” বা “Hospital in the home (HITH)”। চিকিৎসা সেবার এই মডেল অনুসারে কোন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরিবর্তে তার নিজের বাড়িতে অবস্থান করেই চিকিৎসা এবং পর্যবেক্ষণ সেবা পেতে পারেন। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বিকল্প স্বাস্থ্যসেবা ডেলিভারি মডেলের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছিল। এই সময়ে “হোম অ্যাট হসপিটাল” রোগীদের জন্য একটি কার্যকর বিকল্প হিসাবে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বাড়িতে হাসপাতাল কি?
“হসপিটাল অ্যাট হোম” হল চিকিৎসা সেবার একটি মডেল যা রোগীদের তাদের বাড়িতে হাসপাতাল-স্তরের সেবা প্রদান করে। এই মডেল অনুসারে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীসহ স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের একটি দল রোগীদের পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা প্রদান করে থাকে। এর একটি বড় অংশ টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। প্রদত্ত সেবা একটি হাসপাতালের মতোই, যার মধ্যে রয়েছে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, ওষুধ দেওয়া এবং অন্যান্য চিকিৎসা।
বাড়িতে হাসপাতালের লক্ষ্য হল রোগীদের উন্নত মানের সেবা সুলভে প্রদান করা এবং হাসপাতাল-অর্জিত জীবাণু সংক্রমণ এবং অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি কমানো। এর মাধ্যমে রোগীরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতেই অবস্থান করতে পারেন এবং যতদিন প্রয়োজন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থাকতে পারেন। এ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে পদ্ধতিতে খুব ভাল ফলাফল পাওয়া গিয়েছে এবং যারা এভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন, তারা গভীর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বাড়িতে হাসপাতাল কিভাবে কাজ করে?
“হসপিটাল অ্যাট হোম” রোগীদের হাসপাতালের সেটিংয়ের মতই বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান করে। যেমনঃ
– দূরবর্তী পর্যবেক্ষণঃ বিভিন্ন টেলিডিভাইসের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীদের পর্যবেক্ষণ করা হয়, যা রোগের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসূচকগুলি ট্র্যাক করতে পারে।
– টেলিহেলথ ভিজিট: রোগীরা ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, চিকিৎসা সম্পর্কে পরামর্শ নিতে পারেন এবং প্রয়োজন হলে সরাসরি হাসপাতালে এসে ভর্তি হতে পারেন।
– বাড়িতে স্বাস্থ্যসেবাঃ প্রয়োজন হলে চিকিৎসাকর্মী ওষুধ দেওয়া, ক্ষত কিংবা ড্রেসিংয়ের যত্ন নেওয়ার জন্য এবং অন্যান্য দরকারী সেবা প্রদানের জন্য বাড়িতে রোগীদের দেখতে আসতে পারেন।
– ডায়াগনস্টিক টেস্টিংঃ রোগীরা বাড়িতে বা কাছাকাছি ক্লিনিক বা ল্যাবে রক্ত পরীক্ষা এবং ইমেজিং স্টাডির মতো ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করাতে পারেন।
বাড়িতে হাসপাতালের সুবিধা কি কি?
ঐতিহ্যগত হাসপাতালের যত্নের তুলনায় বাড়িতে হাসপাতালের নানানরকমের সুবিধা রয়ছে।
– হাসপাতাল থেকে অর্জিত জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসঃ নিজের বাড়িতে সেবা নেওয়ার ফলে, রোগীদের অন্যান্য জীবাণু সংক্রমণের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা কমে যায়।
– উন্নত ফলাফল: যেসকল রোগী বাড়িতে চিকিৎসা গ্রহণ করেন তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তুলনায় সুস্থতা অর্জনের ফলাফল ভালো।
– রোগীদের বাড়তি সন্তুষ্টিঃ অনেক রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়া পছন্দ করেন, কারণ এটি তাদের জন্য সুবিধাজনক, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দৈনন্দিন রুটিন বজায় থাকে।
– স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের খরচ কম হয়ঃ বাড়িতে হাসপাতাল ঐতিহ্যগত হাসপাতালের যত্নের চেয়ে কম ব্যয়বহুল। কারণ ব্যয়বহুল হাসপাতালে থাকার প্রয়োজনীয়তা দূর করে, বিভিন্ন ধরণের আনুষঙ্গিক খরচের পরিমাণ অনেক কমিয়ে দেয়।
– স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ লাঘব করেঃ সবচেয়ে বড় কথা জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে এখন অনেক দেশেই হাসপাতালের ওপর চাপ অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছে। অনেক ক্রনিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়। ফলে হাসপাতালে বেডের ক্রাইসিস কোনভাবেই লাঘব করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব হলে হাসপাতালের ওপর চাপ কমে এবং স্বাস্থ্যসেবার খরচও কমে যায়।
বাড়িতে হাসপাতালের চ্যালেঞ্জঃ
বাড়িতে হাসপাতালের অনেক সুবিধা থাকলেও, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে রয়ছেঃ
– সীমিত প্রাপ্যতাঃ বাড়িতে হাসপাতাল এখনও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়নি এবং সব রকমের রোগীদের জন্য একটি প্রযোজ্য নয়।
– প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাঃ দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ এবং টেলিহেলথ সেবা দেওয়ার জন্য কার্যকরী সামগ্রী থাকতে হবে।
– সেবা প্রদানের সমন্বয়ঃ রোগীর বাড়িতে যত্ন প্রদানের জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন, যা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
এত রকম চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, বাড়িতে হাসপাতালের ভবিষ্যত সম্পর্কে অনেকেই আশাবাদী। স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তির অগ্রগতি অব্যাহত থাকায়, সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক রোগী দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ এবং টেলিহেলথ সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা এবং ব্রিটেনে বাড়িতে হাসপাতালের সম্ভাবনা নিয়ে বেশকিছু পাইলট প্রোগ্রাম চলমান যা বাড়িতে হাসপাতালের কার্যকারিতা পরীক্ষা করছে। এই প্রজেক্টসমূহ বাড়িতে হাসপাতালের সেবাদানের বিভিন্ন মডেলের কার্যকারিতা, সেইসঙ্গে রোগীর ফলাফল এবং স্বাস্থ্যসেবা খরচের উপর প্রভাব মূল্যায়ন করছে। বাড়িতে হাসপাতালের ভবিষ্যত এবং স্বাস্থ্যসেবা বিতরণে এর ভূমিকা নির্ধারণে এই গবেষণাসমূহের ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ হবে।
বর্তমান সময়ে বাড়িতে হাসপাতাল বা “হসপিটাল অ্যাট হোম” অনেকের নিকটে অবাস্তব মনে হলেও, অদূর ভবিষ্যতে এটা স্বাস্থ্যসেবা বিতরণের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। কারণ এটা সময়ের দাবী।