স্ট্রোক রোগীদের নিরাপদ ও সক্ষম জীবনের জন্য

সুজন মাহমুদ
সুজন মাহমুদ
5 Min Read

স্ট্রোক রোগীদের নিরাপদ ও সক্ষম জীবনের জন্য

ভয়েস অফ মেহেরপুর

অনলাইন ডেস্কঃ   অনেকের ভ্রান্ত ধারণা, স্ট্রোক হচ্ছে হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যা। এটি মস্তিষ্কের একটি রোগ। এতে রক্তনালির জটিলতার কারণে হঠাৎ করে মস্তিষ্কের একাংশ কার্যকারিতা হারায়।

আমাদের দেশে স্ট্রোকের হার প্রতি হাজারে ১২ জন এবং স্ট্রোকের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রতি বছর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কাজনক তথ্য জানান, ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া রোগীর মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে।

স্ট্রোক হওয়ার প্রধান করণ

* অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ * অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস * ধূমপান * নিয়মিত মদ্যপান * হার্টের অসুখ- রিউমেটিক ভাল্বুলার ডিজিস, অ্যারিদমিয়া * স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা * দিনভর বসে কাজ করা এবং কায়িক শ্রম না করা * ফাস্টফুড বেশি খেলে (বাচ্চাদের ও তরুণদের স্ট্রোকের জন্য দায়ী) * রক্তে কলেস্টেরল চর্বি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে।

বিরল কারণগুলের মধ্যে- রক্তনালির গঠনগত ত্রুটি (ARTERIOVENOUS MALFORMATION, AVM), রক্তরোগ যেমন- হাইপারকোয়াগুলোপ্যাথি, কোলাজেন সমস্যাগুলো অন্যতম।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ইসকেমিক স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেকটাই বেশি কারণ ডায়াবেটিস রোগীদের Atherosclerosis বেশি হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি। শরীর এ অতিরিক্ত শর্করাকে Lipogenesis (লাইপোজেনেসিস) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্নেহ পদার্থ/চর্বি (lipid/fat)তে পরিণত করে। এ ফ্যাট জমতে থাকে রক্তপ্রবাহের ভেতর। ক্যাথল্যাবে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ক্যারোটড অ্যাথেরেক্টমি বা Endartarectomy হরহামেশাই করা হচ্ছে যা মেজর স্ট্রোক ও নিশ্চিত পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচাতে পারে।

স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

* ওজন কমাতে সুষম খাবারের ওপরই ভরসা রাখুন। দামি নয়, দেশি ও সহজলভ্য খাবার দিয়ে থালা সাজান।

* ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি ও দেশি ফল।

* সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধা ঘণ্টা করে দ্রুত হাঁটতে হবে বা ২ দিন ১৫০ মিনিট জগিং করতে পারেন।

* ধূমপানের বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

* প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।

* ব্লাড প্রেশার আর সুগার বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে হবে।

* শরীরচর্চার সময় খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অত্যাধিক পরিশ্রমসাধ্য বা ক্লান্তিকর না হয়।

মাইল্ড স্ট্রোক (TIA)

মাইল্ড স্ট্রোক হল স্ট্রোকের মতো কিছু উপসর্গ যা কয়েক মিনিটব্যাপী থাকে এবং তৎপরবর্তীতে শরীরের কোনো স্থায়ী দুর্বলতা দেখা যায় না। চিকিৎসা না নিলে মাইল্ড স্ট্রোক পরবর্তীতে রোগীদের প্রতি ১০ জনে ১ জন তিন মাসের মধ্যে মেজর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।

মাইল্ড স্ট্রোকের উপসর্গ

* হাত, মুখ, পা বা শরীরের এক পাশ হঠাৎ দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া।

* হঠাৎ কথা বলতে বা বুঝতে না পারা।

* চোখে দেখতে অসুবিধা বা ঝাপসা দেখা।

* তীব্র মাথাব্যথা।

প্রতিরোধে করণীয়

নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই হতে পারে স্ট্রোক থেকে বাঁচার প্রধান উপায়। এ ছাড়া কয়েকটি লাইফ সেভিং ওষুধ অভিজ্ঞ রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে পারেন।

ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ

* এনটি প্লাটেলেট- লো-ডোজ অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল।

* এনটি কোয়াগুলেন্ট- রিভারক্সাবেন, চর্বি কমানোর ওষুধ- অ্যাটোরভাস্টাটিন, ভিটামিন-ই ক্যাপসুল এবং ফ্লুনারিজিন (ভেসোডায়ালেটর) ইত্যাদি ৪-৫টি ওষুধ নিয়মিত সেবন করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা মনে করেন।

স্ট্রোক সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিক করণীয়

* BE FAST (lost Balance, dropping Eye, deviated Face, Arm paralysis, slurring Speech, Time) লক্ষণগুলো দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বা নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া।

* মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরন নির্ণয় করা।

অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে

* শ্বাসনালি, শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্ত সঞ্চালন নিয়মিত রাখার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে।

* রোগীকে একদিকে কাত করে, বালিশছাড়া মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে।

চোখ ও মুখের যত্ন নিতে হবে।

* প্রস্রাব আটকে গেলে বা প্রস্রাব ঝরলে প্রয়োজনে ক্যাথেটার দিতে হবে।

* পুষ্টি ও খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে নাকে নল দিতে হতে পারে।

স্ট্রোক এখন কোনো ব্যক্তিরোগ নয়, এর প্রভাব পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় জীবনে প্রতীয়মান। স্ট্রোক সম্বন্ধে সঠিক তথ্য নিজে জানুন, বন্ধুদের জানান। মনে রাখুন টাইম ইজ ব্রেন। স্ট্রোকপরবর্তী প্রতি মিনিটে ২ মিলিয়ন মস্তিষ্কের কোষ মারা যায়। গোল্ডেন আওয়ার- সাড়ে ৪ ঘণ্টায় কমপ্রিহেনসিভ চিকিৎসার আওতায় এলে বেঁচে যাবে স্নায়ুকোষ, কর্মক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকবে। চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য মৃত্যুঝুঁকি কমানো, কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা এবং পরে যেন স্ট্রোক না হয় তার ব্যবস্থা করা। সময়মতো চিকিৎসা পেলে ৩০-৭০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

লেখক : স্ট্রোক বিশেষজ্ঞ ও এন্ডোভাস্কুলার নিউরো সার্জন, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

Share This Article