বঙ্গবন্ধু: এক মহাজীবনের গল্প | আবদুল্লাহ আল আমিন

আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বিত্ত-বৈভবের জন্য বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেননি। তিনি রাজনীতি করেছেন বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক মুক্তির জন্য ।

আবদুল্লাহ আল আমিন
আবদুল্লাহ আল আমিন
22 Min Read

যে-মহাজীবনকে ঘিরে বাংলাদেশের নবজন্ম সেই মহাজীবনের নাম মুজিব— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকের বুলেটে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সমান আয়ুষ্কাল তিনি পাননি। তারপরও মাত্র ৫৫ বছরের জীবন-পরিক্রমায় বাঙালি ও বাংলাদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যা করেছেন, তা বোধ হয় বিশ্বের কোন জননায়কের পক্ষে সম্ভব হয়নি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কী করে তিনি ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪,১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১- এই বছরগুলোয় ধাপে ধাপে পূর্ববঙ্গের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বাঙালির অন্তরে স্বদেশপ্রেমের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে বাংলার মানচিত্রটা বদলে দেন। সামান্য একজন রাজনৈতিক-কর্মী থেকে একটি স্বাধীন দেশের স্থপতিতে উন্নীত হন। ভেবে বিস্মিত হই, কী করে তিনি পরাধীন, নির্জীব, ভীতু-ভেতো বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী, স্বপ্নমুখী, স্বাধীনতাকামী করে তুলেছিলেন! ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান বলেছে,‘শেখ মুজিব এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’। ফিন্যান্সিয়াল টাইম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জোর দিয়েই বলেছে যে, ‘ মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না’। ভিন্নমতাবলম্বীরাও স্বীকার করেছেন যে, মুজিবের নেতৃত্বে-ই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এ কারণে সম্ভবত বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের মত নেতাকেও লিখতে হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় পরিচিতি নির্ধারণে তাঁর চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। শেখ মুজিব ছিলেন সেই ব্যক্তি, জীবনব্যাপী যিনি এই জাতির স্বার্থে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন, বিরাজ করেছিলেন সেই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে।’ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আবিদ খান টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক মহৎ মানুষকে দেখেছি, তাঁদের সঙ্গে কাজও করেছি। আমি মহাত্মা গান্ধীকে দেখেছি, দেখেছি পণ্ডিত নেহেরু আর অন্য অনেককে। কিন্তু শুধু একজনের কথাতেই জীবন দিতে পারতাম। তাঁর নাম নেতাজি।’ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পর উপমহাদেশের আর একজন নেতা যার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে এবং দিতে পারতো। তিনি বঙ্গবন্ধু- আমাদের প্রিয় মুজিব— শেখ মুজিবুর রহমান।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন এক মানবদরদি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি কোনো বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, কোনো বাঙালিকে শত্রু ভাবেননি। অথচ কী আশ্চর্যের বিষয়, বাঙালি নামের একদল মানুষরূপী হায়েনার হাতে তিনি ও তাঁর পরিবারবর্গ নৃশংসভাবে নিহত হন। জাতির জনকের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড, যা কিনা, চিন্তানায়ক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিবেচনায় ছিল ‘ঈৎরসব ড়ভ ঃযব ঈবহঃঁৎু্থ ও ঈৎরসব ধমধরহংঃ যঁসধহরঃু্থ। জানি না, আমরা সেই বীভৎস, সেই হৃদয়বিদারক, সেই ঘৃণিত হত্যাকাণ্ডকে কোনোদিন ভুলে যেতে পারবে কিনা! ইতিহাসের নানা পর্বে নানা গৌরবগাঁথা রচিত হয়, আবার তার পাশাপাশি নানা কলঙ্কময় অধ্যায়ও রচিত হয়। যারা শ্বেতশুভ্র ইতিহাসের গায়ে কলঙ্ক তিলক এঁকে দেয়, তারা কেউ শাস্তি পায়, কেউ পায় না। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তারা খুনি-বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই চিহ্নিত থাকে। মুজিবের খুনিরাও ইতিহাসের পাতায় রক্তপিপাসু হায়েনা, খুনি-বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। যাই হোক ‘মৃত্যু যতই মর্মান্তিক হোক,—- তা কখনোই জীবনকে আড়াল করতে পারে না, বরং কখনো কখনো একটা ভিন্ন মহিমা দিতে বাধ্য হয়। হত্যাকারীদের নিশ্চয় এ-ধরনের পরিকল্পনা থাকে না যে, যাকে তারা হত্যা করতে যাচ্ছে তিনি মৃত্যুর দ্বারা আরো পরিব্যাপ্ত দীপ্তি লাভ করবেন। তারা ভাবে, একে হত্যা করা হল তো একে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া গেল, গোধূলির কালো জলে সূর্যকে নিক্ষেপ করার মতো–। ইতিহাস বারবার এই দুরাকাঙ্ক্ষাকে উপহাস করে, উপমহাদেশে গান্ধী বা মুজিবের হত্যাকাণ্ডে যেমন দেখা গেছে। কারণ তাদের মৃত্যুর পূর্বগামী ছিল এক কীর্তি-উজ্জ্বল বিশাল জীবন, মানুষের জন্য নিবেদিত জীবন। এমন জীবনকেই মৃত্যু মহিমান্বিত করে।’ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন আরও মহিমান্বিত, আরও উজ্জ্বলতর হয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করেও তাঁকে ইতিহাসের পাতা থেকে একবিন্দুও সরানো যায়নি।

 

বঙ্গবন্ধু


দুই.
না, এখানে আমি মুজিবের হত্যাকাণ্ড নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করতে চাই না, বরং এখানে মুজিবের সংগ্রামমুখর, কীর্তি-উজ্জ্বল, বহু-বর্ণিল জীবনের নানা পর্ব নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তারপরও মনের মাঝে বারবার প্রশ্ন জাগে, যে-মুজিব পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে নির্জীব-নিরুদ্যম বাঙালি জাতিকে রূপান্তরিত করেন লড়াকু জাতিতে, তিনি কেন স্ত্রী-পুত্রসহ শহীদ হলেন? দেশের সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ কেন দেশের রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ককে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো না? যে-মুজিব কারাগারের অন্তরাল থেকে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস মথিত করে রেখেছিলেন, তাঁকে হত্যা করার সাহস খুনিরা পেল কোথায়? কারা কারা এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ব্লুপ্রিন্ট তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিল? কেন তাঁর মৃত্যুতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হল না? কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়নি? যা-ই বলি না কেন, কোনভাবেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায় এড়িয়ে যেতে পারি না, তা বারবার এসে সামনে দাঁড়ায়। পিতৃহত্যা, জননী-নব বধূ-নারী-শিশুহত্যার দায় বাংলাদেশকে নিতেই হবে। সক্রেটিশকে হত্যা করে প্রাচীন গ্রীস যে পাপ করেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমরাও ওই এক-ই পাপ করেছি। মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, তিনি কেন খুনিদের চিনতে পারলেন না! তিনি কি একা হয়ে পড়েছিলেন? মর্মান্তিক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫-এর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। ভেবে আকুল হই যে, এ-ই কি তাঁর ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রাপ্য ছিল শেষ বিচারে? গভীর অনুতাপের বিষয়– এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ থেকে কোনও প্রতিবাদই উঠল না, ভারত থেকেও নয়।’ এখানেই শেষ নয়, তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি একুশ বছর। ইনডেমনিটি এ্যাক্ট প্রণয়ন করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। তবে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার বলেন, ‘ তোমরা আমার প্রিয়বন্ধু মুজিবকে হত্যা করলে, আমারই দেয়া ট্যাংক ব্যবহার করে। আমি নিজেকেই অভিশাপ দিচ্ছি কেন আমি তোমাদের ট্যাংক দিয়েছিলাম’।


মুজিবের যত জীবনী পড়ি, যত ছবি দেখি, ততই বিস্মিত হই। একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসে, তা হল, অবিভক্ত বাংলার এক প্রান্তিক জনপদ– গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কী করে মুজিবের মত এক বিস্ময়কর-জনচিত্তজয়ী নেতা তৈরি হল? ব্রিটিশ ভারতে নেতারা আসতেন শহরের অভিজাত পরিবার থেকে। এদের মধ্যে কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার, কেউ অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী, কেউ-বা আইসিএস পাস। কেউ আবার স্বনামধন্য রাজনীতিকের পুত্র বা উত্তরসূরি। কিন্তু মুজিব এসবের কিছুই ছিলেন না। ঢাকা কিংবা কলকাতায় নয়, টুঙ্গিপাড়ার মতো একেবারে সাধারণ গ্রামে তাঁর জন্ম। মহাত্মা গান্ধী-মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ’র মত ব্যারিস্টারি পড়তে তিনি বিলেতে যাননি। আবার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মতো কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেও আসেননি, তিনি এসেছিলেন গোপালগঞ্জের সচ্ছল কৃষক পরিবার থেকে। অবশ্য তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান মহকুমা অফিসের সেরেস্তাদার ছিলেন। তারপরও সবাইকে ছাড়িয়ে যান তিনি। তাঁর বীরত্ব যেমন ছিল; তেমনি ছিল মানুষকে জাগিয়ে রাখার, নেতৃত্ব দেবার ও সম্মোহিত করার অলৌকিক ক্ষমতা। মানুষকে কাছে টানতে পারতেন, পারতেন তাদেরকে নিয়ে সংগঠন করতে। সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সাংগঠনিক শক্তি, ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতা দিয়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করে তোলেন। ইতিহাসের চাকাকে তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির পক্ষে; এ জনপদের মানুষকে দেখিয়েছিলেন উন্নত, পরিণত ও স্ব-শাসিত স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন । নতুন করে নির্মাণ করেছিলেন বাঙালি জনসমাজকে যার ফলে স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার জন্ম হয়েছিল। আবুল হাশিম, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি, ভাসানীরা যা পারেননি; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তা পেরেছিলেন। এ কারণেই তিনি ইতিহাসের মহানায়ক-শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি। অনেক বাঙালি (বাংলাদেশ ও ভারতের) বঙ্গবন্ধুর ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’র অভিধাটি নিয়ে একটু সংশয়ে পড়ে যান। কেউ কেউ আবার তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটা দিতেও কুণ্ঠিত হন। কেউ আবার এই অভিধার পালটা দাবিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম তুলে ধরেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে, ২০০৪ সালে বিবিসির জনমত জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে এই শিরোপাটি জয় করে নেন। বিবিসির এই জরিপ প্রমাণ করে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা-ভাষাভাষীর কাছে তিনি এক মহান বাঙালি যিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বাংলাদেশে অনেকেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, ভবিষ্যতেও অনেকে হবেন, তবে তারা কেউ শেখ মুজিব হতে পারবেন না। শেখ মুজিব এক দুর্লভ মহাজীবনের নাম।


তিন.
ঢাল-তলোয়ারহীন একটি জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সামরিক জাতিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায় বলতে হয়: ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরামের দল রাতারাতি সামরিক জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।… সাত কোটি সন্তান আর শুধু বাঙালী নয় এখন মানুষ হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের মতে কবিগুরুর উক্তি এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কবিগুরু জীবিত থাকলে তিনিও সেই কথা বলতেন।’ একজন জননায়কের মধ্যে যতটুকু ক্যারিশমা বা সম্মোহনী শক্তি থাকা দরকার, তার সবটুকুই ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। ক্যারিশমা দিয়েই তিনি সাত কোটি বাঙালির অন্তরে জ্বালাতে পেরেছিলের সম্প্রীতি, সাহসিকতা ও মানবিকতার দীপশিখা। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু পাশ্চাত্য মডেলের সেক্যুলার ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। মহাত্মা গান্ধী মাস মবিলাইজেশনের মাধ্যমে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এক অর্থে তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিটা মজবুত করে গেছেন। সেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন আরএসএস ও সংঘ-পরিবারের নিবিড় পরিচর্যায় এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। অবিভক্ত বাংলার বাঙালি মুসলমান এলিটরাও ছিলেন হাড়েহাড়ে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল। কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন এক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব । একমাত্র তিনিই হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসীসহ জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন।


বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের সাউথ এশিয়া সেন্টারে আয়োজিত “ইধহমধনধহফযঁ ধহফ ঠরংরড়হং ড়ভ ইধহমষধফবংয” শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেন, ‘সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা এবং ধমকে রাজনীতির বাইরে রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর যে মতাদর্শ, তা এখনও সারা পৃথিবীর জন্য প্রাসঙ্গিক’। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভূক্তিকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজম ধারণার মানে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে না, এমন নয়। সেটা ছিল ধমের রাজনৈতিক ব্যবহার হবে না’। তিনি আরও বলেন, ‘এটা এমন নয় আমরা ধর্মপালন বন্ধ করবো। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবাই তার ধম পালন করবে। কেবল ধমের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ থাকবে’। বঙ্গবন্ধুর দশনের কথা বলতে গিয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে সম্রাট আকবরের মতাদর্শের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন এবং বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও সম্রাট আকবরের মতাদর্শ এখনও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটা কেবল ভারতের জন্য নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। ইউরোপ-আমেরিকার রাজনৈতিক আলোচনায় তাদের ধারণার ব্যবহার করা যেতে পারে’। বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধ’ু হিসেবে উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, তার মতাদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ সুফল পেতে পারে।


বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারা উপলব্ধি করা যায়, তাঁর দেয়া একটি উদ্ধৃতি থেকেও। তিনি লিখেছেন:
‘আমি মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা যে ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’৬ এই উদ্ধৃতি থেকে বঙ্গবন্ধুর আত্মপরিচয়, রাজনৈতিক চিন্তাধারা উপলব্ধি করা যায়। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন দার্শনিক মওলানা আজাদ সোবহানি ও আবুল হাশিমের রব্বুবিয়াত দশন দ্বারা। পরবর্তীতে তাঁর কর্মপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি ও বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি এক গভীর ভালবাসা ও আত্মীয়তা অনুভব করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি পূর্ববাংলার জনগণকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, “এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি, যারা আছেন তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপরে– আমাদের যেন বদনাম না হয়।”


ব্যক্তিগত জীবনে বঙ্গবন্ধু নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন, কোরান শরিফ পড়তেন। তারপরও তিনি সকল নাগরিকের নিজ নিজ ধম পালনের অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে তিনি রাজনীতিতে ধমের ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার সমানাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তার প্রেরণায় ১৯৭২-সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো এবং এর মর্মচেতনা ও মূলনীতি সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন:
“ পূর্ববাংলা এখন স্বাধীন। স্বাধীন হয়ে তার নাম এখন বাংলাদেশ।.. সেও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেও চায় গণতান্ত্রিক সংবিধান।… সেও সমাজতন্ত্রের অভিমুখে যাত্রা করতে উন্মুখ। নতুন রাষ্ট্রের স্তম্ভ। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা। সমাজতন্ত্রের অভিমুখে গতি। সোনার বাংলা, মতির গণতন্ত্র, হীরার ধর্মনিরপেক্ষতা, পান্নার সমাজতন্ত্র– এই যদি হয় নীট লাভ তবে যা হারিয়েছি তা সার্থক। এসব জিনিস আরো সস্তায় মেলে না।৮ এ থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি তথা মুজিববাদকে অন্নদাশঙ্কর রায় সোনা-মোতি-হীরা-পান্নার সঙ্গে তুলনা করেন। তার ধারণা, এই আদর্শে রক্তস্নাত বাংলাদেশ যদি পরিচালিত হয়, তবে কালক্রমে তা আধুনিক, প্রগতিশীল ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে জানতেন যে, পাকিস্তানের শাসন-শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্তি লাভ করতে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে কেবল মুসলমানরাই জীবন দান করেননি, হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরাও সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছে। যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ছিল না। তাই বাংলাদেশকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি মনে করতেন যে, এই যে রক্তস্নাত বাংলাদেশ এটা পাকিস্তানের মত মুসলিম সম্প্রদায়ের একার রাষ্ট্র নয়। এটা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকদের রাষ্ট্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও অনুতাপের বিষয়- বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতি উল্টো-পথে যাত্রা করেছে, সংবিধানকে কাঁটাছেড়া করে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।


একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি চাইতেন, মুসলিম লীগ কৃষক, ছাত্র-যুবক ও মধ্যবিত্তের সংগঠন হয়ে উঠুক। সে কারণে দলটিকে ‘জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের’ কবল থেকে মুক্ত করতে শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে তিনি লড়াই করেছেন। জীবনের প্রতিটি পর্বে তিনি বাঙালির ক্ষমতায়ন ও সার্বিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন। চিন্তা করেছেন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। সব ধরনের স্বৈরতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটিয়ে বাংলার গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ও বাঙালির স্বপ্নলালিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তিনি বলতেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা- বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়’।


ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে- এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিটি সংগ্রামে তার ছিল সরব ও উজ্জ্বল উপস্থিতি। আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বিত্ত-বৈভবের জন্য বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেননি। তিনি রাজনীতি করেছেন বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক মুক্তির জন্য । এই পরাধীন জনপদের ভেতর থেকে কৃষক চেয়েছে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিক চেয়েছে তার শ্রমের যথার্থ মূল্য ও সামাজিক নিরাপত্তা, নাগরিক মধ্যবিত্ত চেয়েছে চাকরি, চিন্তা-মত প্রকাশের স্বাধীনতা, উদীয়মান বুর্জোয়া চেয়েছে তার পুঁজির বিস্তার ও বিকাশ। সংস্কৃতিকর্মীরা চেয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন। বঙ্গবন্ধু সবার কথা শুনেছেন ও ভেবেছেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাটাতনে সব শ্রেণিকে শামিল ও ঐক্যবদ্ধ করে নির্মাণ করেন নতুন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরও তিনি এক মুহূর্তের জন্য বসে থাকেননি। সবাইকে নিয়ে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছেন। নির্মাণ করতে চেয়েছেন শোষণমুক্ত,ন্যায়ানুগ উন্নত সমাজ।

ভাষণরত শেখ মুজিব
চার.
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মত চিন্তানায়করা আশা করেছিলেন : ‘স্বাধীনতার আলো বাতাস গায়ে লাগলে বাংলাদেশের মাটিতে রেনেসাঁসের ফুল ফুটবে, রিফরমেশনের ফল ধরবে।’ তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, প্রথম রেনেসাঁস হয়েছিল কলকাতায়, আর দ্বিতীয় রেনেসাঁস হবে ঢাকায়। সমাজের সর্বস্তরে সূচিত হবে বৈপ্লবিক রূপান্তর। এর নাম হবে ‘বাংলাদেশের রেনেসাঁস’। আর সেই রেনেসাঁসের নেতৃত্ব দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু নানামুখী ষড়যন্ত্র, সংকট ও সমস্যার কারণে বঙ্গবন্ধুর রেনেসাঁস মুভমেন্ট মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রত্যাশার বিপ্লব পর্যবসিত হয় চরম হতাশায়। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, খুন-সন্ত্রাস-ডাকাতি-লুট-রাহাজানি, সেনাবাহিনী-রক্ষীবাহিনীর টানাপোড়েন, স্বাধীনতা বিরোধীদের তৎপরতা। মৌলবাদী শক্তির ক্রম-উত্থান, চরমপন্থী রাজনৈতিক শক্তির নাশকতা, রিলিফ বিতরণ ও উন্নয়নকাজে দুনীতি, কারো কারো ক্ষমতার অপব্যবহার, ভারত-বিরোধিতা,.. কালো টাকার বাড়-বাড়ন্ত, চরম বেকারত্ব… জাতীয় ঐক্যের অন্তরায় ও জন-অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমলাদের ব্যর্থতা ও সহকর্মীদের দুনীতি তাঁকে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করে। এ প্রেক্ষিতে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সব বেটাই চোর। যাকেই দায়িত্ব দিতাছি, সেই-ই চুরি করতাছে। এবার ভাবতাছি, ফ্রান্সের দ্য গলের মত রিটায়ার করুম। পাবলিক মিটিং-এ বলুম এবার আপনারা নতুন নেতা দেখেন।’ দেশের সার্বিক উন্নয়নের চিন্তা করে বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। বঙ্গবন্ধু এ দলের সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। এই পরিবর্তনের ফলে দেশে-বিদেশে কিছু প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়। কারণ ‘সংবিধানের এই আমূল পরিবর্তন মুজিবের জীবনের এ্যান্টিক্লাইমাক্স।’ দেশের উন্নয়ন ও মঙ্গলের জন্য বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় ও সংকল্প যে সৎ ও মহৎ ছিল, সে ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই নিঃসংশয় ও নির্দ্বিধ ছিলেন। তবে পদ্ধতি সম্পর্কে সবাই একমত পোষণ করতে পারেননি। কারণ বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। অনেকেই ভেবেছেন, কেন তিনি একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন? তারপরও জনগণ বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকতে চেয়েছে। কারণ অধিকাংশ মানুষ মনে করতো, তিনি আমাদের ‘বটগাছ’। তিনি যা করেছেন তা দেশের সার্বিক মঙ্গলের ভেবেই করেছেন। এ কারণে যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, তাঁর যুগটাই বাঙালি জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ যুগ। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায় বলতে হয়: ‘নেপোলিয়নের যুগটাই ছিল ফরাসিদের সবচেয়ে গর্বের যুগ। আর জুলিয়াস সিজারের যুগটাই ছিল রোমানদের সবচেয়ে গৌরবের যুগ। তেমনি বাংলাদেশের নাগরিকরাও মনে রাখবে এই উপকথা যে মুজিবের যুগটাই ছিল তাদের সবচেয়ে পৌরুষের যুগ।– মুজিব বাংলাদেশের আত্মা। তিনি রেখে গেছেন একটা লিজেন্ড। বাংলাদেশ চিরকাল সেটা মনে রাখবে।’


বঙ্গবন্ধু যে-লিজেন্ড, যে-পৌরুষ, যে-চেতনা রেখে গেছেন, তার আলোকে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে চলেছি। আশা করি, একুশ শতকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ পরিণত হবে উন্নত রাষ্ট্রে। ইতোমধ্যেই পরিবর্তনের ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে গ্রাম-নগর-জনপদ। নরওয়েজিয়ান অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও তার সঙ্গী জে আর পারকিনসনের ১৯৭৬ সালে লেখা ‘বাংলাদেশ দ্য টেস্ট ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা বোধ হয় মিথ্যে হতে চলেছে। তারা বলেছিলেন, দেশটি জন্ম থেকেই সাহায্যনির্ভর, যত দিন যাবে, এই নির্ভরতা বাড়তে থাকবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন প্রকাশ্যে। তিনিসহ মার্কিন নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বা ‘বাস্কেট কেস’ বলে অভিহিত করেন। কিসিঞ্জার ও ফাল্যান্ডদের সব অনুমান ও থিসিস-ই মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর উন্নয়নের পরীক্ষাক্ষেত্র নয়, বরং তার উল্টোটা। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনাম হয়, ‘বাংলাদেশ, নো মোর বাস্কেট কেস’। অর্থনীতিবিদরাও এখন বাংলাদেশ নিয়ে লেখেন, ‘আ ডেভেলপমেন্ট মিরাকল’। অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেশি। কিন্তু মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ। আশা করা যায়, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বঙ্গবন্ধু বারবার আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা বলতেন। সে লক্ষে বর্তমান সরকার এগিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক টানাপড়েন, জঙ্গিবাদী তৎপরতা- কোন কিছুই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা আটকে রাখতে পারেনি । নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ,নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগের ভিত্তি রচনা, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা- বাংলাদেশকে নতুন ভাবমূর্তি নিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন আর কোন পরাশক্তি বা দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার স্পর্ধা দেখায় না। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি শহর হয়ে উঠবে সচ্ছল ও স্বনির্ভর। ম্যাক্সিম গোর্কি ছেলেবেলাই লিখেছিলেন, ‘আশ্বাস জাগে যে একদিন না একদিন আমাদের দেশের মানুষ এক পূর্ণ প্রস্ফুটিত জীবনের সৌন্দর্যে ও উজ্জ্বল মানবিকতায় অধিষ্ঠিত হবে।’ বঙ্গবন্ধুও সারাজীবন বাঙালির পূর্ণতা ও বিকশিত জীবনের জন্য লড়াই ও সংগ্রাম করে গেছেন। আশা করা যায়, আগামী দু দশকের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ হবে এবং তাঁর স্বপ্নের রোডম্যাপ ধরে ধনে-গুণে-মানে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা’।


– আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিনের জন্ম মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটী গ্রামে, ১ জানুয়ারি ১৯৭৩। আকবর হায়দার ও জাহানারা বেগম তার পিতা-মাতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক-সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি অধ্যাপনায় যুক্ত হন। বর্তমানে মেহেরপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মূলত প্রাবন্ধিক ও অনুসন্ধিৎসু গবেষক। তাঁর চর্চা ও অনুসন্ধিৎসার বিষয় সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকধর্ম ও লোকজ সংস্কৃতি। গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটিতে।

প্রকাশিত গ্রন্থ: ব্রাত্যজনের রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১২), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি: মেহেরপুর (২০১৩), ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালির সম্প্রীতি সাধনা (২০১৬), বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি-ভাবনা (২০১৭)।

Share This Article