লেখক দস্তেয়ভস্কির জেলের নির্যাতনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটা বই আছে The house of the dead নামে, এই উপন্যাসে আসলে তেমন কোন প্লট নাই, মূলত জেলের বিভিন্ন রকমের শাস্তি, নানারকমের অভিজ্ঞতা, অপরাধী সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন মনস্তত্ত্ব নিয়ে দস্তয়েভস্কির বিভিন্ন অবজার্ভেশন নিয়ে লেখা বইটা।
এই বইতে এক জায়গায় দস্তয়েভস্কি একটা আইডিয়া শেয়ার করছিলো জেলের ভিতরকার পিউনিটিভ বা হার্ড লেবার মানে শাস্তিমূলক কঠিন শ্রম নিয়ে। তো শাস্তি দেওয়ার সিস্টেমগুলা নিয়ে চিন্তা ভাবনার পর দস্তয়েভস্কির বক্তব্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তি, যে শাস্তিতে কঠিনতম খুনীদের হৃদয়েও কাপন ধরে যাবে সেটা হচ্ছে তাদেরকে দিয়ে ননসেন্স, ইউজলেস কাজ করানো। যেমন রাশিয়ার কারাগারগুলাতে বন্দীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন রকমের কাজ করানো হতো, যেমন ইট বানানো, পাথরভাঙ্গা এইগুলা। এখন এইসব কাজ করার ফলে বন্দীদের কোন ব্যক্তিগত লাভ হতো না, বা এসব কাজ করে তারা টাকা পয়সা পেতো না। কিন্তু তারপরেও অনেকেই এই কাজগুলা অনেক মন দিয়ে করতো, কত দ্রুত কাজগুলা কত সুন্দরভাবে করা যায় এটা নিয়ে অন্যদের সাথে বা নিজের সাথে প্রতিযোগিতা করতো, কারণ দিনশেষে তাদের যে কাজ ছিলো- ইট বানানো বা পাথরভাঙ্গা এইগুলার একটা সোশ্যাল রিলেভেন্স বা মিনিং আছে, এইগুলা কোন একটা বাড়ি বা ব্রিজ তৈরিতে কাজে লাগে, তাই এই কাজগুলা অনেক পরিশ্রমের হলেও বন্দীরা সেগুলা করতে পারতো।
কিন্তু একই ব্যক্তিকে ধরেন বলা হইলো সে এক বালতি থেকে পানি আরেক বালতিতে ঢালবে, বা এক জায়গা থেকে মাটি তুলে আরেক জায়গায় নিয়ে যাবে আবার সেটা ফেরত নিয়ে আসবে, এই টাইপের মিনিংলেস কাজ তাহলে বন্দীদের ব্রেইন সিমপ্লি জেলি হয়ে যাবে, এবং এই মিনিংলেস কাজ করা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য দরকার হলে মানুষ খুন করে হলেও ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অর্জন করে নিবে তাও এইসব অর্থহীন কাজ সে করতে পারবে না। এই কারণে দেখবেন গ্রীক পুরাণে সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তিগুলা শারীরিক ধাচের না হয়ে এই অর্থহীন কাজ করে যাওয়ার ফলে যে মানসিক পীড়া তৈরি হয় সেইভাবেই ডিজাইন করা হয়েছিলো। যেমন- সিসিফাসের পাহাড়ে পাথর তুলে আবার সেই পাথর পড়ে যাওয়া, লিবিয়ার রাজা দানাউসের ৫০ কণ্যা দানাউদসদের ছিদ্রযুক্ত পাত্রে পানি ভরার শাস্তি বা গ্রীক নরক টার্টারাসে দেবতা জিউসের পুত্র টান্টালাসের চিরকাল ব্যাপী পানি আর ফল খেতে হাত বাড়িয়েও ফল বা পানি কোনটাই না পাওয়ার পণ্ডশ্রমের যে শাস্তি সবগুলার মূল ফিলোসফি একটাই- মানুষের তার কাজের মাধ্যমে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার যে বেসিক ইম্পালস আছে সেটাকে একটা আরোপিত অর্থহীনতার মাধ্যমে সাবভার্ট করে দেওয়া।
জিনিসটা হচ্ছে অস্ট্রিয়ান সাইকোথেরাপিস্ট ভিক্টর ফ্র্যাংকল তার লগোথেরাপি সংক্রান্ত বইগুলাতে যা দেখিয়েছেন মানুষ হচ্ছে মিনিং মেকিং অ্যানিমাল। তার দুনিয়ার সব কষ্ট সহ্য করতে পারবে যদি সে ওই কষ্টের পিছনে একটা মিনিং দাড় করায় নিতে পারে, কিন্তু তার অর্থ তৈরির মেকানিজমই যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সে আর নিজেকে বাঁচাতে পারবে না।
এখন বিশ্বের বৃহত্তম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বাংলাদেশের জনগণদের জীবনের প্রাইমারি অর্থ হচ্ছে নিজের শরীরের মাংস পিষে দেশের ক্ষমতায় থাকা এলিটদের লুটপাটের টাকা জোগানো। এই অর্থনৈতিক যুক্তির হিসাবে দেশের গার্মেন্টস শ্রমিক, রেমিটেন্স শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক এদের আজীবন কঠিন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়ে গেছে, তারা ওই হিসাবে খেটে যাচ্ছে।
কিন্তু যেহেতু এই দেশের এলিটরা বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন আর বৈশ্বিক ও ভারতের মত আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে নিজেদের টেকনোলজিকাল আর সব ধরণের ইনোভেশন সেক্টর বিক্রি করে দিয়েছে আর ঋণখেলাপি ও টাকাপাচারের মাধ্যমে অবাধ লুটপাটের এক হাঙ্গার গেম দেশে চালু করে দিছে তাই এই দেশের রপাইভেট ইন্ডাস্ট্রি বা অন্যান্য উৎপাদনমুখী ক্ষেত্রে তেমন কোন বিকাশ নাই, আর এই সেক্টরগুলার বিকাশ না থাকায় এই লাইনে চাকরি বাকরিও তেমন তৈরি হচ্ছে না। এর বাদে সামগ্রিকভাবে সমাজেও বেসিক জ্ঞানচর্চার কোন মূল্যায়ন নাই।
এখন আমাদের বাবাদের জেনারেশনের একটা বড় অংশ গ্রামের বাড়ির অর্থকরী ফসল পাট বা বড় অ্যামাউন্টে ধান বিক্রির পয়সা দিয়ে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি করে মিডল ক্লাস শ্রেণীতে উপনীত হয়েছেন, এবং ৮০-৯০ দশকের বাংলাদেশে যে ইকোনমিক বুম তৈরি হচ্ছিলো তাতে তারা অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু এই ২০২৩ এ সিলিংবিহীন লুটপাটের আমলে এসে দেশের বাস্তবতা পুরাই ভিন্ন। ৮০-৯০ এর দশকের অপ্টিমিজম এখন “সংস্কৃতি-পাগলু”দের নাচাগানা ছাড়া আর কোথাও অবশিষ্ট নাই। দেশ এখন আক্ষরিক অর্থেই টিএস এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড বা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় মধ্যবিত্ত আমলের চাকরি বাকরি- ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকতা, বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি এইগুলা চাহিদার তুলনায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। ডাক্তারি আর উকিলগিরি পেশাটা ধিমিধিমি করে টিকে আছে নিজেদের পেশার কোর এথিক্সগুলার সাথে সীমাহীন কম্প্রোমাইজের মাধ্যমে, এইগুলাও ভবিষ্যতে বিভিন্ন উপায়ে বেহাত হয়ে যাবে। মানে স্যালারিয়েট হয়ে একটা মধ্যবিত্ত নিরাপদ জীবন যাপনের যে স্বপ্নটা আমাদের বাবারাও দেখতো সেটা আমাদের জন্য এখন অলীক কল্পনায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু তারপরেও যেহেতু মানুষ পুরাতন চিন্তা ধারার ফেটিশিজম থেকে বের হতে পারে না তারই ধারাবাহিকতা থেকে দেশে এখনও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থহীন “উচ্চতর শিক্ষা” কার্যক্রম চলে, শাসকগোষ্ঠীও চায় এই ফেটিশিজমের চর্চা বজায় থাকুক। উন্নত চিন্তাধারার মানুষ তো দূরে, নিজের সেক্টরে চাকরির নিশ্চয়তাটুকুও দিতে পারতেছে না এই উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গনগুলা। কিন্তু তারপরেও দেশের তরুণ যুবারা জীবন দিয়ে হলেও “পডে” যাচ্ছে, পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, ব্যাকলগও খাচ্ছে, কিন্তু এসব করে তাদের অর্থনৈতিক বা আত্মিক কোন অর্জনই হচ্ছে না, কারণ কোন অর্জন যাতে না হয়, পুরা ব্যাপারটাই যাতে মিনিংলেস হয়ে থামে ওভাবেই সিস্টেম ডিজাইন করা।
দেশের সশ্রম কারাদন্ড প্রাপ্ত গার্মেন্টস রেমিটেন্স, কৃষি শ্রমিকরা তো কাজ করছে। এদের বাদে বাকিদেরকে ঢুকায় দেওয়া হইছে ওই “উচ্চশিক্ষা” নামক এক বালতি থেকে আরেক বালতিতে পানি ঢালার কাজে, বৃথা শ্রম ঝড়ানোর কাজে। ফালতু ননসেন্স কাজে এদেরকে ব্যস্ত রেখে দেশের তরুণদের জীবনিশক্তি ক্ষয় করানোই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলার মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য পালন করতে গিয়েই এখানকার ক্লাসেরও যেমন ফাংশন নাই, আবার পরীক্ষায় গ্রেডিং এর মাধ্যমে যে আরেকবার শেখার সুযোগ করে দেওয়ার ফাংশন সেটাও নাই। শুধু ছেলেপেলেদের একটা ওয়াইল্ড গুজ চেজে ব্যস্ত রাখা আর প্রাতিষ্ঠানিক স্যাডোম্যাসোকিজমের চর্চা করার জন্যই প্রতিষ্ঠানগুলার দরজা খোলা রাখা হইছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সিস্টেমের টোটাল মিনিংলেসকে নানারকমের সুগারকোটিং, বিদেশে চলে যাওয়ার স্বপ্ন নানা রকমের মোটিভেশনাল স্পিচের মাধ্যমে পাতলা করে ঢেকে রাখি। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে সিস্টেমের এই কোটিংটা উঠে আসে এবং পুরা ব্যাপারটার মিনিংলেস তাদের সামনে প্রকট হয়ে উঠে, এবং তারাই এই ইনহিউম্যান সিস্টেমের ভিক্টিম আর মার্টায়ার।
আর এই সিস্টেমই আমাদের টার্টারাস, আমাদের House of the dead, আমাদের Wasteland, আমাদের নন্দিত নরক। আমরা সবাই এখানে সমবেত বন্দী।