হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালি আসলে আক্ষরিক অর্থেই ধর্মপ্রাণ, তবে ধর্মান্ধ নয়। কিছু ব্যতিক্রম (কিছু চটি বইপড়া পণ্ডিত মূর্খ!) বাদ দিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ধর্ম নিয়ে বাঙালি বাড়াবাড়ি করে না। কেতাব পড়ে, শাস্ত্র ঘেঁটে সে ধর্ম পালন করে না। তাই নিরস-খটমটে দার্শনিকতা তার পছন্দ নয়, প্রেম-ভালবাসার গান দিয়ে সে অচেনাকে চিনতে, অজানাকে জানতে চেয়েছে । ভাবরস আর ভাবুকতা দিয়ে সে ‘পরমস্রষ্টা’কে পেতে চেয়েছে। সে কোনোকালেই বিশুদ্ধ ধর্ম পালন করেনি, তার ধর্ম আসলে স্বনির্মিত ধর্ম। সেই কারণে সাভারকার-আরএসএস-এর তত্ত্ব কচকচানি-হিন্দুত্ব আর বাঙালির হিন্দুধর্ম বা হিন্দুয়ানি বোধহয় এক নয়। বাঙালি হিন্দু আর রাজস্থান, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের হিন্দুর মধ্যে ‘ম্যালা’ পার্থক্য । বাঙালি হিন্দুরা যে-ধর্মটা পালন করে বা উদযাপন করে সেটা আসলে কোনো ধর্মযজ্ঞ বা রিচ্যুয়ালস নয়। এটি একটি জনগোষ্ঠীর চলমান-প্রত্যহিক জীবনাচরণ বা ‘ওয়ে অব লাইফ’। এই ধর্মের আঙিনায় শাস্ত্র-পুরাণ, পাঁচালি-ব্রতকথাসহ নানা আচার-আচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত-অতুল প্রসাদ-ডি এল রায়ের গান হাত ধরাধরি করে চলছে।
দুর্গাপূজা যতটা না ধর্মীয়-আচ্চা বা রিচ্যুয়ালস তার চেয়ে অনেক বেশি কার্নিভাল বা অনেক বেশি চোখ ধাঁধাঁনো, ‘হৃদয় হরণী’ ফেস্টিভ্যাল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দুর্গাপূজাকে ঘিরে বড়ো বড়ো কার্নিভাল সেলিব্রেট করছে। বিভিন্ন মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সংগীতানুষ্ঠান কিংবা লোকমেলা। কৃষ্ণগঞ্জ থেকে কৃষ্ণনগর, বহরমপুর থেকে বীরভূমের শান্তিনিকেতন পর্যন্ত রাস্তার দু ধারে অসংখ্য দুর্গামণ্ডপ, কিন্তু কোনো দুর্গামণ্ডপের মাইক থেকে ধর্ম সংগীত ( বীরন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডিপাঠ বাদ দিলে) শোনা গেল না! কোথাও বাবুল সুপ্রিয়-শ্রীকান্ত আচার্য-জয়ন্তীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, কোথাও অতুল প্রসাদ-ডি এল রায়, কোথাও আবার মান্না দে- সন্ধ্যার পাশাপাশি ধ্রুপদ সঙ্গীত। পুরুত মশাই মন্ত্রপাঠ করছেন, ঢাক-ঢোল বাজছে, ধূপধুনোও চলছে কিন্তু এসব ছাপিয়ে বাংলা গান ও বাঙালিয়ানাটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামের মুসলমান চাচারাও ‘পুইজি’ দেখতে যাচ্ছে। তরুণরা প্রবীণদের জিজ্ঞেস করছে, ‘কি ঠাকুর দেখলে তুমি, চাচা?’ অনেক বাড়িতেই ‘কুটুম’ এসেছে, রান্নাবান্নাও চলছে। একটি মণ্ডপে দেখলাম দুর্গা ঠাকুরের চেয়ে সত্যজিৎ রায়ের ( তিনি হিন্দুধর্মের কেউ নন!) ছবিটাই বেশি জ্বলজ্বল করছে। কোনো কোনো মণ্ডপে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি টাঙানো হয়েছে? অথচ, এঁরা কেউই পৌত্তলিক ছিলেন না! কোভিড-১৯ এর পর এবার বেশ জাঁকজমকপূর্ণ পূজা হচ্ছে। এবার UNESCO কলকাতার সর্বজনীন দুর্গাপূজাকে ‘Intangible Cultural Heritage of Humanity‘ ঘোষণা করেছে। ইউনেসকোর স্বীকৃতিপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা এবার বিশ্বজনীন হয়ে উঠলো।