২০১১ সালে গোপালগঞ্জে আপনি আপনার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। গাজীপুর কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি করলেন। বঙ্গবন্ধুর নামে কিশোরগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খুললেন। নওগাঁতে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় বানালেন। জামালপুরে বঙ্গমাতার নামে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বানালেন। এইরকম আরো বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নামে বানালেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান দেখে মনে প্রশ্ন জাগে এইগুলো কি আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়? এইগুলো প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হউক সেটি কি আপনি চান? বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠান করবেন সেটি কি যেমন তেমন প্রতিষ্ঠান হতে পারে? যেন তেন প্রতিষ্ঠান কি তার নামের সুবিচার করে? উনার উচ্চতার সাথে যায়?
আপনার নিজ বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গোপালগঞ্জে যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সেটির মান কেমন? প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যা চলছে তা দেখে কষ্ট হয়। আপনার এইবারের প্রাইম টাইম ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন খন্দকার নাসির উদ্দিনকে। কোন যোগ্যতার মাপকাঠিতে উনাকে ভিসি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন? তাও আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে? সেই সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়েছিল। ছাত্র শিক্ষক মিলে আন্দোলন করতে হয়েছিল তাকে সরানোর জন্য। ‘নিজের ইচ্ছামতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা’ সহ নানা অনিয়মের অভিযোগে উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন আলোচনায় উঠে আসেন। অশোভন ভাষায় কথোপকথনের একটি অডিও সেই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। অডিওতে শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিনিয়াকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন রুঢ় ভাষায় ভৎর্সনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন “তিনি বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? ফাজিল কোথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তুমি জানো না? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তোমাদের মতো বেয়াদব তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তোর আব্বার কাছে শুনিস। গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন? আমি খুলছি বলেই তো তোর চান্স হইছে। না হলে তো তুই রাস্তা দিয়া ঘুরে বেড়াতি। বেয়াদব ছেলে-মেয়ে।’
এই অডিও প্রকাশের পরেও তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরানো হয়নি। শুধু তাই না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে অবৈধ শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগসহ নানাবিধ অনিয়মের খতিয়ান গণমাধ্যমে আসা সত্বেও তিনি ২ মেয়াদের ভিসি ছিলেন। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। আমার একটা নিরীহ প্রশ্ন: ৭৩ এর অধ্যাদেশের বাহিরে বাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল তৈরির প্রাথমিক কাজ এবং ফাইনাল সিলেকশন কারা করে? এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ৫০ কিংবা ৫২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যোগ্যতা নিয়ে একটি গবেষণা হউক। সেই ফিল্টারে কেউ পাশ করবে কিনা আমি শতভাগ সন্দেহ পোষণ করি। বঙ্গমাতার নামে প্রতিষ্ঠান খুলে যা হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মানে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের জন্য প্রার্থী খোঁজে তারা আসলে কি কি যোগ্যতা খুঁজে? নাকি তারা অযোগ্য মানুষদের খুঁজে বের করাই তাদের দায়িত্ব?
সরকার বঙ্গমাতা ন্যাশনাল মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার (BNMRC) নামে একটি রিসার্চ সেন্টার খোলার উদ্যোগ নেয়। এর কাজ বেশ কয়েক বছর আগেই শুরু হয়। যদিও এখনও ভূমি অধিগ্রহণ করাই হয়নি। তার মানে অবকাঠামো নির্মাণ করতে আরও ৫ থেকে ১০ বছর লাগবে। তাতে কি? এর মধ্যেই প্রায় ২৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনা হয়ে গিয়েছে। কল্পনা করতে পারেন? এই যন্ত্রপাতিগুলো চালানোর কোন মানুষই নিয়োগ দেওয়া হয়নি অথচ মেশিন কেনা হয়ে গেছে। এমনকি এইগুলো রাখার বা ইনস্টল করার জন্য জায়গা পর্যন্ত তৈরী হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে একটি কাজই করার তাগিদ থাকে সেটি হলো কর বর্ষ শেষ হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি টাকা খরচ কর। এইটা কোন সিস্টেম হতে পারে? এই যে যন্ত্রগুলো নষ্ট হচ্ছে এই অপচয়ের দায়ভার কার উপর বর্তাবে?
বঙ্গমাতা ন্যাশনাল মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাদেরকে বেশ যোগ্য মনে হয়েছে তবে তাদের হাত পাও মন্ত্রণালয় নামক দড়ি দিয়ে বাধা। যাহোক তাদের কারণে সেখানে একটি মিটিং-এ যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেখানে যা হচ্ছে তার সামান্য কিছু যা জেনেছি তাতে আমি বিস্মিত। আমি বলে এসেছিলাম। সবার আগে যেইসব বিষয়ে সেখানে গবেষণা হবে সেইসব বিষয়ের উপর খ্যাতিমান কিছু বিজ্ঞানীকে আগে নিয়োগ দিন। তার আগে মলিকুলার বায়োলজি বা মাইক্রো-বায়োলজির একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে পুরো বিষয়টার তদারকি করার দায়িত্ব পালনের জন্য একজনকে নিয়োগ দিন যিনি এর নেতৃত্ব দিবেন।
কয়েকদিন আগে “ওপেনহেইমার” সিনেমাটি দেখলাম। সেখানে আমরা কি দেখলাম? আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে। তারজন্য একটি ন্যাশনাল ল্যাব তৈরী হবে। সেই কাজ শুরুর আগে কিছু মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হলো একজন যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করার জন্য যার নেতৃত্বে পুরো প্রজেক্ট, যার নাম বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট, বাস্তবায়িত হবে। এই সিনেমা দেখার অনেক আগেই সেই মিটিং-এ আমি ঠিক এই কথাটিই বলেছিলাম। ইন ফ্যাক্ট, এই চিন্তা আমার কোন মৌলিক চিন্তা না। এর মাধ্যমেই দুনিয়ার সব দেশে সব সফল প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে হোমি ভাভা। ভারতের স্পেস রিসার্চের ক্ষেত্রে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ, পি জে আবুল কালাম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ক্ষেত্রে এমনকি পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রেও প্রথমে একজন বিশেষজ্ঞ নেতা নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এইটা করা হয় না। আর হয়না বলেই আমাদের কোন প্রতিষ্ঠানই সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেনি। এই যে আমাদের সরকার অযোগ্য মানুষদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ছেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান পদে অযোগ্য মানুষদের নিয়োগ দিচ্ছেন তাতে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে যে আমাদের সরকার আসলে মানসম্মত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক সেটাই চায় না। তারা চায় সংখ্যা বাড়ুক, অবকাঠামো গড়ে উঠুক কিন্তু সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান না হউক। যদি সত্যি সত্যি চাইতো তাহলে এত এত প্রতিষ্ঠানের প্রধান অযোগ্য হতো না। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কর্মকান্ড দেখলে কি আদৌ মনে হয় তারা শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা ভাবে? আমাদের শিক্ষার্থীরা যে মানবেতরভাবে আবাসিক হলে থাকে, নিম্নমানের খাবার খায় তারচেয়েও নিম্নমানের পরিবেশ পায় এতদ সত্বেও আজ পর্যন্ত কোন ভিসিকে দেখেছেন সরকারের কাছে জোর দাবি জানাতে যে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে গড়বে যারা সেই ছাত্ররা এমনভাবে থাকতে পারে না। তাদের সুব্যবস্থা তৈরির জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। এই দাবি শুনেছেন কখনো? উল্টো বরাদ্দ যতই কমাক তারা বলবে আমাদের শিক্ষাবান্ধব সরকার হেন্ করেছে তেন করেঙ্গা।
আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার একটি চিত্র পেয়েছেন। সমস্যার বিবরণেই সমাধানের ইঙ্গিত আছে। যেকোন সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক কাজ হলো সমস্যা চিহ্নিত করা। এই লেখাটি যদি পড়ে থাকেন তাহলে সেই কাজটি উদাহরণসহ করতে পেরেছি বলে মনে করি। ভালো থাকবেন।